নিজস্ব প্রতিবেদন:-
ডোনাল্ড ট্রাম্প আর নেতানিয়াহু কিছুটা বিপাকেই ছিলেন। একজনের সামনে নির্বাচনী বৈতরণি, আরেকজনের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির মামলা। রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের শেষ লগ্ন দেখার সংশয়ে থাকা ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুকে সংকট থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করছেন আরবের মিত্ররা। ফিলিস্তিনি স্বপ্নের বুকে ছুরি মেরে নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের হাত শক্তিশালী করার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে উপসাগরীয় দেশ বাহরাইন ও আরব আমিরাত।
আরব আমিরাত ও বাহরাইনের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ঘোষণা কয়েক দিনের ব্যবধানে আচমকাই এসেছে। বেপরোয়া কথাবার্তা ও পদক্ষেপের জন্য সমালোচিত ট্রাম্প তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতায় আরও একবার সবাইকে চমকে দিলেন। তবে ইসরায়েলের সঙ্গে এই দুটি দেশসহ আরও কিছু আরব দেশের গোপন সম্পর্ক নিয়ে কানাঘুষা কয়েক বছর ধরেই আলোচনার টেবিলে ছিল।
ওমানের নতুন সুলতানের সিংহাসন আরোহণের অনুষ্ঠানে নেতানিয়াহু উপস্থিত ছিলেন। নেতানিয়াহুর ওই উপস্থিতি উপসাগরীয় রাজনীতিতে পরিবর্তনের আভাস বলে আগাম মন্তব্য করেছিলেন বিশ্লেষকেরা। সেই আভাস এখন বাস্তব রূপ লাভ করতে শুরু করেছে।
ইসরায়েলের সঙ্গে বাহরাইন ও আমিরাতের চুক্তির ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু। দুর্নীত, বর্ণবাদ উসকে দেওয়া, কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতাসহ নানাবিধ অভিযোগ দুজনের অবস্থাই জেরবার। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সামনে রেখে টানা আন্দোলন চলছে তেলআবিবে। ইসরায়েলের জন্য এই ঘটনা খুবই বিরল।
ইসরায়েল বা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ যা–ই করে, তা-ই সিদ্ধ। কারণ, সবকিছুই ইসরায়েলকে আরও শক্তিশালী ও স্থিতিশীল করার নামে করা হয়। নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও উচ্ছেদ নিয়ে তাই তেমন উচ্চবাচ্য হয় না। ইসরায়েলের সব প্রধানমন্ত্রীর হাতেই ফিলিস্তিনি রক্তের দাগ লেগে আছে।
ইহুদিরা ইসরায়েলকে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমি মনে করে। তাই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীরা এই রাষ্ট্র বাস্তবায়নকে ঈশ্বরের মহান দায়িত্ব পালন হিসেবে মনে করেন। এই প্রতিশ্রুতি থেকে কেউই সরে আসেন না। যদি কারও বিচ্যুতি ঘটেছে বলে সন্দেহ হয়, তবে তার পরিণতি হয় আইজ্যাক রবিনের মতো। ফিলিস্তিনের সঙ্গে অসলো শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের দেড় বছরের মাথায় ১৯৯৫ সালের নভেম্বরে উগ্রপন্থীরা তাঁকে হত্যা করে।
এহেন ইসরায়েলের কোনো প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করা অনেকটাই অসম্ভব ও অবাস্তব এক বিষয়। যা কিছুদিন আগেও অবাস্তব বলে বিবেচিত হতো, এখন সেটাই চোখের সামনে ঘটছে। দিনের পর দিন তেলআবিবের রাজপথে হাজার হাজার ইসরায়েলি কোভিড-১৯–কে উপেক্ষা করেই আন্দোলন করছে।
দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে নেতানিয়াহু শুধু প্রধানমন্ত্রিত্বই হারাবেন না, জেলও হতে পারে তাঁর। কেবল দুর্নীতিই না, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগও দায়ের করা সম্ভব। অবশ্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গত বছরের ডিসেম্বরে ইসরায়েলের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিয়েছেন।
আইসিসির এই উদ্যোগ ইসরায়েল ও নেতানিয়াহুর জন্য খুবই অস্বস্তিকর বিষয়। ইসরায়েলের অনেক নাগরিকের ধারণা, নেতানিয়াহুর ব্যর্থতার কারণেই আইসিসি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ শব্দটি উচ্চারণ করার সাহস পেয়েছে।
আইসিসির যুদ্ধাপরাধের অনুসন্ধানের উদ্যোগ হলো প্রথম ধাক্কা। এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী কাজে সংশ্লিষ্টতাসহ নানা অভিযোগ উত্থাপনের সুযোগ পাবে ফিলিস্তিনিসহ অন্যরা। এই অবস্থার সঙ্গে দুর্নীতির মামলার চলমান বিচার নেতানিয়াহুকে আরও বিপাকে ফেলে দিয়েছে।
ওদিকে নেতানিয়াহুর আরেক বিশ্বস্ত মিত্র ট্রাম্প নির্বাচন নিয়ে মহা ঝামেলায় আছেন। নির্বাচনের ঠিক আগে আগেই কোভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। দেশের ভেতর বর্ণবাদকে উসকে দেওয়া, জেরুসালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দেওয়াসহ নানাবিধ কাজকর্ম করে ট্রাম্প পরিস্থিতিকে অনুকূলে আনার চেষ্টা করছিলেন।
বিতর্কিত হলেও সে পথে বেশ এগিয়েও গিয়েছিলেন। এর মধ্যেই কোডিভ-১৯ এসে হানা দেয়। ট্রাম্প কোভিড-১৯ ছড়ানোর জন্য চীনকে দোষারোপ করেছেন একাধিকবার। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেই কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক ফ্লয়েডকে পুলিশ হত্যা করে। যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লেও ট্রাম্প বরং ঘৃণাবাদ উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
এর মধ্যে বোমা ফাটিয়েছেন ট্রাম্পের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন তাঁর হোয়াইট হাউস নিয়ে স্মৃতিচারণামূলক বইয়ে। সেখানে বোল্টন লিখেছেন, পুনর্বার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সহায়তা কামনা করেছিলেন।
সবকিছু মিলিয়ে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তায় এখন ভাটার টান চলছে। একমাত্র জনপ্রিয়তার জোয়ারই তাঁদের পুরোনো রূপে ফিরিয়ে নিতে পারে। কিন্তু কৃতকর্মের জন্য আবারও নাগরিকদের আস্থা অর্জন সহজ হবে না।
তবে আরব নেতাদের ছোট উদ্যোগ পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে, যদি কোনোভাবে প্রমাণ করা যায় যে আরব নেতারা ইসরায়েলের সঙ্গে আছেন। আরবদের এই উদ্যোগ ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুকে শুধু বিশ্বরাজনীতিতে শক্ত অবস্থান দেবে না, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও নতুন করে শক্তি জোগাবে। বাহরাইন ও আমিরাতের ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তির ঘোষণা সেই শক্তিরই জোগান।
আমরা কমবেশি সবাই জানি, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ইহুদি লবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানবিরোধী নেতা বার্নি স্যান্ডার্স বা যুক্তরাজ্যের জেরেমি করবিনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার পেছনে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে তাদের অবস্থান অনেকটাই দায়ী বলে অনেকে মনে করেন। দুজনই ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলেছিলেন।
যে কারণে করবিনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিসেমেটিক (ইহুদিবিরোধী) অভিযোগের তদন্তও করা হয়েছে। ব্রিটেনের লেবার পার্টিও ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। কিন্তু পাশার দান পাল্টাতে পারেনি। শক্তিশালী এই ইহুদি লবির সমর্থন আদায়ের কাজটি ট্রাম্প জেরুসালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে আগেই কিছুটা সম্পন্ন করে রেখেছিলেন। এখন বাহরাইন ও আমিরাতকে ইসরায়েলের বাহুলগ্ন করে দিয়ে বিষয়টি আরও পোক্ত করে রাখলেন।
ওদিকে নেতানিয়াহু বরাবরই দাবি করতেন, আরব নেতারা তাঁর সঙ্গে আছেন। বিশেষ করে আইসিসি যুদ্ধাপরাধ তদন্তে উদ্যোগী হলে তিনি জোরালোভাবে বিষয়টি উত্থাপন করেন। কিন্তু আরব নেতাদের সমর্থন প্রমাণের প্রয়োজন ছিল। দুর্নীতির মামলা মাথায় নিয়ে নেতানিয়াহু বাহরাইন ও আমিরাতের সঙ্গে চুক্তি করতে ওয়াশিংটন যাচ্ছেন।
এটা ইসরায়েলের পররাষ্ট্রনীতির বিশাল অর্জন। এই অর্জনই নেতানিয়াহুর রক্ষাকবচ হতে পারে। দুর্নীতির মামলা রোধ করতে ইসরায়েলি সংসদ নেসেটে ডানপন্থীদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার। সৌদি আরবের পরোক্ষ সমর্থন এবং বাহরাইন ও আমিরাতের স্বীকৃতি নেতানিয়াহু ও তাঁর দল লিকুদ পার্টির জন্য বিরাট রাজনৈতিক পুঁজি।
ইসরায়েলের নিরাপত্তার ও স্থিতিশীলতার জন্য সমগ্র আরবের সমর্থন প্রয়োজন এবং নেতানিয়াহু ও লিকুদ পার্টিরই আরবদের বশীভূত করার সক্ষমতা আছে—এটা ভোটারদের মনে গেঁথে দিতে পারলেই নেসেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন কঠিন কিছু হবে না।