নিজস্ব সংবাদদাতা :- ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি(NIA) কর্তৃক মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ৬ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর যেভাবে সামনে আসে তা সাধারণ মানুষের মাঝে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অল ইন্ডিয়া পিপলস ফোরাম, অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা প্রটেকশন অব ডেমোক্র্যাটিক রাইটস, এনআরসি বিরোধী সংহতি মঞ্চ, আজাদ হিন্দ ফেডারেশন, পিপলস রিভিউ ও অল ইণ্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে একটি যৌথ প্রতিনিধিদল গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ এই সম্পর্কিত তথ্যানুসন্ধান চালায়। রানীনগর-২ অঞ্চলের কালিনগর গ্রামের আবু সুফিয়ান ও মুর্শিদ হাসান, ডোমকল থানার হিতানপুরের নাজমুস সাকিব ও ডোমকল পুরনো বিডিও অফিস মোড়ের লিউ ইয়েন আহম্মেদের বাড়ি ও পাড়ার সাধারণ মানুষের সাথে কথাবার্তা বলে তথ্যানুসন্ধানী দল। তার ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি,
১) ধরপাকড় অভিযান চলে গভীর রাতে। অভিযানে বহু সংখ্যক বিএসএফ জওয়ান, স্থানীয় থানার দুজন করে অফিসার এবং কয়েকজন সিভিক পুলিশ ও এনআইএ অফিসার – সব মিলিয়ে প্রায় ৪০-৫০ জনের মত বাহিনী ছিল বলে জানান গ্রামবাসীরা। দুজন পুলিশ অফিসার ছাড়া বাকি সকলেই সাধারণ পোষাকে ছিল এবং কারও পোশাকেই নাম পরিচয় বা পদমর্যাদাসূচক কিছু দেখেননি গ্রামবাসীরা।
২) কোথাও দরজা ভেঙ্গে, কোথাও পাঁচিল টপকে বাড়িতে ঢোকে বাহিনী।
৩) গ্রেপ্তারের সময় মারধোর করা হয়। আবু সুফিয়ানকে কোদালের বাঁট খুলে তা দিয়ে হাত ও পায়ের আঙ্গুলে পেটানো হয়। আবু সুফিয়ানের ১৫ বছর বয়সী নাবালক ছেলে ওয়াসিম আক্রমকে চড়-থাপ্পড় ও ঘুসি মারা হয়। ওয়াসিমের আরেক ভাইকে, যার বয়স দশ বছর, চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকানো হয়। আবু সুফিয়ানের মেজ দাদা জিন্নাতুল ইস্লামকে প্রথমেই দুটো থাপ্পড় মেরে তারপর তার ভাইএর সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। লিউ ইয়েন আহম্মেদকে গালে থাপ্পড় ও চোখে ঘুসি মারা হয়।
৪) ধৃত ও তাঁদের পরিবার সম্পর্কে ইঙ্গিতপূর্ণ কটূক্তি করা হয়। নাজমুস সাকিবের দাড়ি সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়।
৫) পরিবারের হাতে গ্রেপ্তার সংক্রান্ত কোনও রকম কাগজপত্র দেওয়া হয় নি। বারবার জানতে চাওয়া সত্বেও গ্রেপ্তারের কোনও কারণ মৌখিকভাবেও জানানো হয় নি। নাজমুস সাকিবের ক্ষেত্রে বলা হয় যে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
৬) কি কি জিনিস বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে তাও জানানো হয়নি পরিবারের মানুষদের।
৭) পূরণ না করা একাধিক ফর্ম/কাগজে আত্মীয়দের স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়েছে। নাজমুস সাকিবের ক্ষেত্রে বাজেয়াপ্ত করা ল্যাপটপ ইত্যাদির তিনটি পিপি (পলি প্যাক, যার মধ্যে বাজেয়াপ্ত করা জিনিস রাখা হয়) ছাড়াও আরও তিনটি ফাঁকা পিপি সই করিয়ে নিয়েছে তার দাদা রিজওয়ান আলিকে দিয়ে।
৮) একটি ক্ষেত্রে (আবু সুফিয়ানের ক্ষেত্রে) ধৃতকে স্থানীয় থানার বদলে জলঙ্গীর বিএসএফ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।
৯) মিডিয়া ‘সুড়ঙ্গ’ বলে প্রচার করেছে যে চৌকো গর্তটিকে তা গোসলখানার চেম্বার। এরকম চেম্বার ঐ গ্রামে আরও অনেক আছে। পৈতৃক বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট জায়গায় নতুন নির্মীয়মান বাড়িতে স্ত্রী নুরুন্নেসা ও চার নাবালক ছেলেকে নিয়ে গরিব দর্জি তথা প্রান্তিক কৃষক আবু সুফিয়ানের সংসার। বাড়ির মধ্যেই গোসলখানার চেম্বার বানানো এই এলাকার স্বাভাবিক পদ্ধতি।
১০) এই গ্রামেরই মুর্শিদ হাসান নামে ২২-২৩ বছরের যে যুবককে কেরালার এরনাকুলাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এনআইএ তার বাড়ি বলতে ছোট্ট খুপরি মতো পাটকাঠির বেড়া দেওয়া ঘর, যেখানে তাঁর বাবা ও মা থাকেন। বাবা কোন কায়িক শ্রম করতে পারেন না। ছেলে কেরলে কাজ করে টাকা পাঠালে তাঁরা বেঁচে থাকার সাহারা পান। মুর্শিদের মা জানান যে তাঁর নিজের ও মুর্শিদের নার্ভের সমস্যা আছে। বহরমপুরে ডাক্তার দেখাতেন। বড় ছেলে মুর্শিদের আয়ের ওপর পরিবার চলে। বর্তমানে পাড়া প্রতিবেশীর দানে খাবার খাচ্ছেন।
১১) ডোমকল কলেজে কম্পিউটার সায়েন্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নাজমুস সাকিব ছোটোবেলা থেকেই রুগ্ন ও দুর্বল প্রকৃতির এবং মেধাবী। বর্তমানে থায়রয়েড, গলব্লাডারে পাথর ও জণ্ডিসে ভোগেন। পড়ুয়া ধরণের। সারাক্ষণ বইপত্রে মজে থাকেন, বাড়ির বাইরে যাওয়া বলতে একমাত্র কলেজ আর নামাজ পড়তে মসজিদ। তাঁর সমস্ত কাগজপত্র তছনছ করে তল্লাশি চালিয়ে শেষ পর্যন্ত স্কুল কলেজের সার্টিফিকেট ও একটি নামাজ শিক্ষার বই বাজেয়াপ্ত করে এনআইএ – একেই বোধ হয় “জিহাদি লিটরেচার” বলে উল্লেখ করা হয়েছে এনআইএ’র বিবৃতিতে।
১২) সাকিবের একাউন্টে টেররিস্ট নেটোয়ার্কের টাকা আসার খবর প্রচারিত হয়েছে। এবিষয়ে জানা যায় যে তাঁর আব্বার সঙ্গে ব্যাঙ্ক অফ ইণ্ডিয়ায় একটা যুগ্ম সেভিংস আমানত আছে সাকিবের। এটিই সাকিবের একমাত্র ব্যাঙ্ক একাউন্ট। বড় ভাই রিজওয়ান সেই পাসবই দেখান, যেখানে কোন অস্বাভাবিক লেনদেন চোখে পড়েনি তথ্যানুসন্ধানী দলের। যুবশ্রীর ১৫০০ টাকা করে তাঁর ওই আমানতে ঢুকত।
১৩) ডোমকল পুরাতন বিডিও মোড়ের বাসিন্দা লিউ ইয়েন আহম্মেদ, বয়স ৩৬ বছর, অবিবাহিত। শৈশবে পিতৃহারা, এইচএস পাস করে এলেক্ট্রিকের কাজ শেখেন। ডোমকল কলেজে ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রির ক্যাজুয়াল কাজ ও ডোমকলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইলেক্ট্রিকের কাজ করা তাঁর পেশা। বৃদ্ধা মা, স্বামীর ঘর ছেড়ে আসা দিদি ও দিদির মেয়েকে নিয়ে ভাঙাচোরা টালির চাল দেওয়া কুঁড়েঘরে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে লিউ ইয়েনের বাস। তাঁর পেশার কাজে ব্যবহৃত ইলেক্ট্রিক টুলস ছাড়া আর কোনও কিছুই তাঁর কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত হয় নি।
১৪) গ্রামবাসীরা একইসাথে ক্রুদ্ধ ও আতঙ্কিত। ক্রুদ্ধ, কারণ টিভি মিডিয়াতে যে প্রচার তাঁরা শুনছেন তা তাঁদের কাছে সম্পূর্ণ অবমাননাকর অবাস্তব অপপ্রচার মনে হচ্ছে। আতঙ্কিত, কারণ তাঁরা কাউকেই তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে সত্য কথা বলতে শুনছেন না এবং ভয় পাচ্ছেন যে অনুরূপ অভিযান হয়তো আরও চলবে। আমাদের তথ্যানুসন্ধানী দলটি যে মিডিয়া থেকে আসেনি তা বুঝিয়ে বলার পরই একমাত্র সকলে তাঁদের কথা বলতে শুরু করেন। ধৃতরা সকলেই নিজের গ্রামে পরোপকারি ও আদর্শবান চরিত্রের মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গ্রামবাসীরা সমস্বরে জানিয়েছেন যে এনআইএর এই তদন্তকে তাঁরা বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেন না।
১৫) ১৯-০৯-২০২০ তারিখে এনআইএ’র দেওয়া প্রেস বিবৃতিতে ধৃতদের সরাসরি “টেররিস্ট” বলে অভিহিত করা হয়েছে। অথচ কোনও অভিযুক্তই গ্রেপ্তারির সময় ন্যুনতম কোনও প্রতিরোধ করেন নি। যেমন, নাজমুস সাকিব নিজেই বাড়ির মূল দরজা খুলে দিয়েছিল এবং অফিসাররা যখন তার দাদাকে জিজ্ঞাসা করছিল যে সাকিব কোথায়, তখন সাকিব সেই অফিসারের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। স্পষ্টতই বোঝা যায় নাজমুস সাকিব এনআইএ’র কাছে মোটেই চিহ্নিত ছিল না, এবং নাজমুসেরও কোনও ধারণা ছিল না যে তাঁকেই গ্রেপ্তার করতে এসেছে ওরা। লিউ ইয়েন বা আবু সুফিয়ান স্বাভাবিকভাবেই খুব ভয় পেয়ে গেছিলেন, কিন্তু গ্রেপ্তারির সময় কোনও প্রতিরোধ তাঁরা করেননি।
১৬) এনআইএ’র অভিযানের ধরণটি স্পষ্টত ষড়যন্ত্রমূলক এবং আতঙ্ক তৈরী করার মত করে সাজানো। গভীর রাতে বিশাল বাহিনী নিয়ে গ্রামে ঢুকে বাড়ি ঘিরে ফেলা, দরজা ভেঙ্গে ঢোকা, মারধোর ও গালিগালাজ করা – এসবই এনআইএ’র বিদ্বেষপূর্ণ ও নিপীড়নমূলক মনোভাবকে দেখিয়ে দেয়। সেই সাথে, ধৃতদের পরিবারের কাছে কোনরকম অ্যারেস্ট মেমো বা সিজার লিস্ট না দেওয়া এবং থানার বদলে বিএসএফ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া থেকে বোঝা যায় যে দেশের এই সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থাটি ন্যূনতম আইনানুগ পদ্ধতি মেনে চলে না। সমগ্র অভিযানটিকে ‘অ্যারেস্ট’ না বলে বরং ‘অপহরণ’ বলা চলে। তুলে নিয়ে যাওয়ার পাঁচ দিন পর আমাদের তথ্যানুসন্ধানী দল যখন তাঁদের পরিবারের কাছে যায় তখনও পরিবারের কেউ জানেন না কোন অপরাধে কেন এবং কোথায় তাঁদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। লোকাল থানাতে গিয়েও কোনও জবাব পান নি তাঁরা, কেবল মিডিয়ার উগ্র প্রচার থেকে জানতে পেরেছেন যে ওরা নাকি ‘টেররিস্ট’। এবং, একাধিক ফাঁকা কাগজ ও ফাঁকা পলি প্যাকে বাড়ির লোকেদের সই করিয়ে নেওয়া থেকে এই অভিযানের ষড়যন্ত্রমূলক দিকটি স্পষ্ট হয়।
১৭) অভিযানে লোকাল থানার পুলিশ অফিসার ও সিভিক পুলিশের অংশ নেওয়া থেকে বোঝা যায় যে এই অভিযান রাজ্য পুলিশ প্রশাসনের অজ্ঞাতসারে হয় নি। কিন্তু থানাতে এ বিষয়ে খোঁজখবর নিতে গেলে কিছুই জানানো হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, দিল্লির বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। পরিবারের লোকেরা চাইছেন গ্রেপ্তার হওয়া প্রিয়জনদের সাথে একবার সাক্ষাৎ করতে, অন্ততপক্ষে জানতে যে তাঁরা কেমন আছেন।